দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক ইমেরিটাস প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম বিশিষ্ট মননশীল লেখক, ভাষাতত্ত্ববিদ, নজরুল বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক ছিলেন। বিশাল ক্যানভাসে বিপুল তাঁর কর্মযজ্ঞ। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ঐতিহাসিক আলোকচিত্র গ্রহণের জন্য তিনি জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। তিনি ১৯৩৪ সালে ১লা জানুয়ারী চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার বালাকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জুলফিকার আলী এবং মায়ের নাম জান্নাতুন্নেসা। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর এবং ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য ১৯৭৬ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ভাষাতত্ত্বে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মিশিগান অ্যান আরবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ও হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইষ্ট ওয়েষ্ট সেন্টারে।
১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু। সেই যে শিক্ষকতা শুরু করলেন- তারপর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিরামহীন দীর্ঘ ৬২টি বছর শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মত কর্মদ্যগী ও উদ্ভাবন নিপুন মানুষ এই সমাজে বিরল। যাঁদের অবদানে এ দেশে শিক্ষার ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে তিনি তাঁদের একজন।
রফিকুল ইসলাম ইউল্যাবের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি একজন মুক্তপ্রাণ সফল প্রশাসক। যিনি সমষ্টির কল্যানব্রতে নিবেদিত প্রশাসক ছিলেন।
ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী মানবতাবাদী লেখক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। মানুষের আত্মিক মুক্তি, সৃজনশীল বিকাশ এবং মৌলিক অধিকারের বিষয় নিয়ে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ৬৫টি অনবদ্য গ্রন্থ। বিনয়, উদারতা ও পরমসহিষ্ণুতা ছিল রফিকুল ইসলামের স্বভাবধর্ম। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, আদর্শনিষ্ঠ সহজ সরল মানুষটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ঢাকা নজরুল একাডেমীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং নজরুল ইনষ্টিটিউট ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন। পুনরায় তিনি ২০২১ সালে ১৮মে বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রফিকুল ইসলাম তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বহুবিধ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, নজরুল ইনষ্টিটিউট থেকে নজরুল স্মৃতি পুরস্কার, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া থেকে নজরুল একাডেমী পুরস্কার, চ্যানেল আই ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক আজীবন (লাইফটাইম) সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জাহানারা ইসলাম।
প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী রফিকুল ইসলাম বেতার ও টেলিভিশনে সফল উপস্থাপক ও জনপ্রিয় কথক ছিলেন।
রফিকুল ইসলাম শুধু একটি নাম নয়। একটি আর্দশ। একটি প্রতিভা। সর্বোপরি একটি প্রতিষ্ঠান।
২০২১ সালের ৩০শে নভেম্বর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রফিকুল ইসলাম পুরো জাতিকে কাঁদিয়ে পরোলোক গমন করেন। এমন ক্ষণজন্মা শিক্ষাবিদের তিরোধানে ইউল্যাবের শুধু নয়-সমগ্র জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হল।
-অধ্যাপক কাজী মদিনা